ইন্টারনেট
হোম / লাইফস্টাইল / বিস্তারিত
ADS

মেস্তা বা রোজেলার গুণের নেই শেষ

28 March 2022, 6:41:31

মেস্তা বা রোজেলায় আছে কমলালেবুর তুলনায় প্রায় ৯ গুণ এবং পেয়ারার তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি ভিটামিন সি।

অত্যন্ত কম খরচে মেস্তা বা রোজেলা আমাদের ভিটামিন সির প্রধানতম উত্স হয়ে উঠতে পারে।

এ ছাড়া মেস্তা বা রোজেলা থেকে পাওয়া যায় ভিটামিন বি ওয়ান, বি টু, বি সিক্স, ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, প্রোটিন ইত্যাদি।

রোজেলা টি ইদানীং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে চা-প্রেমী মানুষের কাছে। প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি ও ডি থাকার কারণে অনেকেই করোনা প্রতিরোধের জন্য টোটকা হিসেবে পান করছেন রোজেলা ফুল গরম পানিতে ফুটিয়ে নিয়ে বানানো রোজেলা টি। এই রোজেলা টি পান করতে করতে এর বংশ-পরিচয় খুঁজে ফেলা যাক।

সরেল (Sorell) নামেও পরিচিত এই গুল্মজাতীয় উদ্ভিদটির আদি ভূমি পশ্চিম আফ্রিকা বলে মনে করা হয়। জবা ফুলের সমগোত্রীয় এই গাছের আঁশ থেকে একসময় কাপড় তৈরির সুতা উৎপন্ন করা হতো। এ ছাড়া পাটের বিকল্প হিসেবেও এটি চাষ করা হতো আমাদের দেশে। মেস্তাশাক এখনো খাওয়া হয়। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে এর ফুল পানিতে ফুটিয়ে পানের প্রচলন ছিল। পরবর্তী সময়ে এর ফুল, পাতা ও বীজের ঔষধি গুণের কথা ব্যাপকভাবে জানা যায়।

নামের বাহার
জনপ্রিয় জবা ফুলের চা বা হিবিস্কাস টির মতোই এখন বিশ্বে রোজেলা টি সবার কাছে সমাদৃত। আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ও ইন্দোনেশিয়ার মতো আমাদের এই উপমহাদেশেও এই গাছ আনাচকানাচে ছড়িয়ে আছে। তবে অঞ্চলভেদে এর নামকরণের বিভিন্নতা সত্যি বিস্ময়কর। আমাদের এই বাংলাদেশে বাংলাভাষীদের মধ্যে রোজেলা যে নামগুলোতে প্রধানত পরিচিত, সেগুলো হচ্ছে চুকই, চুকর, মেস্তা, মেসট, হইলফা ইত্যাদি।

বিভিন্ন ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর মধ্যে এর ব্যাপক ব্যবহার ও প্রচলন রয়েছে, যা ভাষা ভেদে ইপলি আরা, জেঙ্গা, কোটলে আরা, লাল কুদরুম, যুগি থেপা ইত্যাদি নামে পরিচিত। আবার ওপার বাংলায় কোনো কোনো স্থানে একে খুব মজার এক নামে ডাকা হয়। তা হলো টক ঢ্যাঁড়স। এই নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে চুকই বা মেস্তা অম্ল স্বাদযুক্ত। এর পাতা আমাদের বাংলাদেশে টক পাতা নামে পাওয়া যায়, যা কিনা শাক হিসেবে খাওয়া হয়।

পুষ্টিগুণ
দেখতে অদ্ভুত মনোহর এই লাল টুকটুকে চুকই ফুলের রসাল পাপড়িগুলোর রূপ-গুণ দুই-ই উল্লেখ করার মতো। এতে আছে গসিপেক্টাইন, হাইবিসিসটাইন এবং সাবদারেটিন নামের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা কিনা আজকালকার বহুল প্রচলিত বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত ও জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড খাদ্যে থাকা খুবই ক্ষতিকর ফ্রি র‍্যাডিক্যালের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অত্যন্ত কম খরচে এই মেস্তা আমাদের ভিটামিন সির প্রধানতম উত্স হয়ে উঠতে পারে। এতে কমলালেবুর তুলনায় প্রায় ৯ গুণ এবং পেয়ারার তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি ভিটামিন সি আছে। এ ছাড়া চুকই বা মেস্তা থেকে পাওয়া যায় ভিটামিন বি ওয়ান, বি টু, বি সিক্স, ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, প্রোটিন ইত্যাদি।

গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বাস্থ্য রক্ষা ও চিকিৎসার উদ্দেশ্যে চুকই বা মেস্তার প্রচুর ব্যবহার দেখা যায়। এতে যথেষ্ট পরিমাণ পেকটিন থাকায় প্রাকৃতিকভাবে জেল তৈরি করার সক্ষমতা আছে বলে এর পাপড়ি, বৃতি ও বীজ কোষ্ঠকাঠিন্য উপশমে ব্যবহৃত হয়।

চুকই বা মেস্তা একাধারে অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিসেপটিক এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণসম্পন্ন বলে আমাদের প্রাত্যহিক খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে এর অন্তর্ভুক্তি বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এই মহামারির বিপৎসংকুল সময়ে চুকই চা পানের অভ্যাস আমাদের প্রয়োজনীয় ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের প্রধান উৎস হয়ে উঠতে পারে। সাধারণভাবে আমাদের দেশের বনে-বাদাড়ে, আনাচকানাচে, এমনকি বাড়ির উঠোনে নিজে নিজেই জন্মানো এই চুকইগাছ আদিকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে খাদ্য, পানীয় ও ঔষধি হিসেবে।

গরম ভাতের সঙ্গে শুকনা মরিচ ও রসুনে ভাজা চুকই বা মেস্তার শাক অত্যন্ত উপাদেয়। এ ছাড়া এর ফুলের লাল পাপড়িগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে তা যুগ যুগ ধরে রান্নায় ব্যবহার করা হয় গ্রামবাংলায়। ছোট মাছের চচ্চড়ি, ভর্তা, খাট্টা, ডাল, চাটনি—সবকিছুতেই টক স্বাদের চুকই বা মেস্তা এক অনন্য মুখরোচক স্বাদ নিয়ে আসে। এ ছাড়া মেস্তা দিয়ে জ্যাম, জেলি, চাটনি তৈরি করে বহু দিন সংরক্ষণ করা যায়।

চা বা পানীয়ের উপকারিতা
প্রতিদিন অন্তত এক কাপ রোজেলা টি আপনাকে সুস্থ রাখতে পারে
প্রতিদিন অন্তত এক কাপ রোজেলা টি আপনাকে সুস্থ রাখতে পারে ছবি: পেকজেলসডটকম
চুকই ফুলের পাপড়ি শুকিয়ে তা দিয়ে প্রস্তুত করা চা পুরো বিশ্বে উচ্চ রক্তচাপ, রক্তের তারল্যসংকট, হৃদ্‌রোগ, রক্তের অতিরিক্ত কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিসের মতো প্রাণঘাতী রোগের চিকিৎসায় সমাদৃত। এই ফুলের লাল রঙের পাপড়ি শুকিয়ে গরম পানিতে ভিজিয়ে চা বা পানীয় বানালে তার রূপ, স্বাদ, গন্ধ—সবকিছুই হয় অনন্য, যা বেশির ভাগ ঔষধি পানীয়ের সঙ্গে তুলনা করলে খুবই ব্যতিক্রমধর্মী। স্বাদ বাড়ানোর জন্য এতে সামান্য মধু, গোলমরিচের গুঁড়া, ভাজা জিরার গুঁড়া বা বিট লবণও দেওয়া যায়। এই পানীয় ঠান্ডা বা গরম যেভাবে ইচ্ছা, দিনে যতবার ইচ্ছা পান করা যায়। শুধু গ্যাস্ট্রিক-আলসারের রোগীদের এই অম্ল স্বাদযুক্ত চা সেবনের বেলায় একটু সাবধান হওয়া উচিত। হাড়ের ক্ষয়রোগ, হাড়ের গিঁটে বাত, মূত্রজনিত বা মূত্রনালির সমস্যা, মুখের ঘা ইত্যাদি রোগেও চুকইয়ের চা পান করে অনেক সুফল পাওয়া যায়।

বাণিজ্যিক চাষ
উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই চুকই বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে একে ফসল হিসেবে একটি সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত করা যেতে পারে। চুকই বা মেস্তা দিয়ে উৎপাদিত চা, আমসত্ত্বের মতো ফ্রুট স্ন্যাক্স, জ্যাম, জেলি, জুস, আচার ইত্যাদি প্রক্রিয়াজাত করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। ভূমিরূপ ও জলবায়ুজনিত কারণে সিলেট অঞ্চলে এই চুকই ব্যাপক আকারে চাষ করা সম্ভব। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট সাম্প্রতিক সময়ে বন্য প্রজাতির চুকই (এম-৭১৫) থেকে গবেষণার মাধ্যমে একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। এই জাত ২০১০ সালে বিজেআরআই মেস্তা-২ (সবজি মেস্তা-১) নামে পরিচিত।

চুকই বা মেস্তার গুণের কথা যেমন বলে শেষ হওয়ার নয়, আমাদের দেশে একেবারে সর্বজনীনভাবে কিছুটা অপ্রচলিত খাদ্য উৎস হওয়ার কারণে এর যথাযথ প্রচার-প্রসারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রতিদিন অন্তত এক কাপ চুকই চা বা রোজেলা টির রক্তিমাভ সৌন্দর্য আর চনমনে স্বাদ আমাদের সবার ঘরে ঘরে সুলভে সুস্বাস্থ্যের বার্তা নিয়ে আসুক।

সূত্র:‘দ্য বেনিফিট অব রোজেলা প্ল্যান্ট’, জিএমবাবু, স্টিমিটডটকম

‘চুকুর হতে পারে বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় ফসল’, এ কে এম আমিনুল ইসলাম, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

ADS ADS

প্রতিছবি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Comments: