ইন্টারনেট
হোম / স্বাস্থ্য / বিস্তারিত
ADS

অতিরিক্ত চিনি খাওয়া শরীর ও মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর

23 October 2022, 7:59:33

মানবদেহের জন্য চিনি প্রয়োজন হলেও অতিরিক্ত গ্রহণ করলে তা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ মারা যান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র মতে, পুরুষদের দিনে ৯ চামচ এবং মহিলাদের ৬ চামচের বেশি চিনি খাওয়া ঠিক নয়। দিনে যত ক্যালোরি শরীরে যায়, তার থেকে ১০-১৫ শতাংশের কম আসা উচিত চিনি থেকে।

চিনি আখ বা মিষ্টি বিট থেকে তৈরি হয়। শিল্পকারখানায় রিফাইনিং পদ্ধতিতে আখের রস থেকে চিনি তৈরি করার সময় ভিটামিন, মিনারেল, প্রোটিন, এনজাইম এবং অন্যান্য উপকারী পুষ্টি উপাদান দূর করে অপ্রাকৃতিক উপাদানে পরিণত করে। ফলে অতিরিক্ত চিনি খেলে চিনির বিষক্রিয়ায় শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হয়।

অতিরিক্ত চিনি সেবনের কারণে আমাদের শরীরে পুষ্টি এবং প্রোটিনের অভাব হয়ে থাকে। অনেক বেশি চিনি জাতীয় খাবার দেহের বিশেষ করে মস্তিষ্কের প্রোটিন এবং পুষ্টির শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। যে কারণে মস্তিষ্কের নিউরন এবং কোষ বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়, মস্তিষ্কের উন্নতি হয় না। এতে আমাদের মস্তিষ্কে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই চিনি খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে।

প্রাথমিকভাবে আমরা যখন চিনি বা মিষ্টি জাতীয় কোনো খাদ্য গ্রহণ করি, ব্রেইনের মেসোলিম্বিক ডোপামিন সিস্টেম উদীপ্ত হয়ে ওঠে। সহজ কথায়, ডোপামিন নামক রাসায়নিকের নিঃসরণ ঘটে যা মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টারকে প্রভাবিত করে। একটা পজিটিভ বা ফিল গুড একটা অনুভূতি কিন্তু চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবারের সাথে জড়িত থাকে অবশ্যই। ফলে অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার প্রবণতা ধীরে ধীরে এডিকশনে পরিণত করে।

মানুষের মস্তিষ্কের থাকা অসংখ্য নিউরনের পুনর্বিন্যাসের প্রক্রিয়াকে বলে নিউরোপ্লাস্টিসিটি। যখন অতিরিক্ত চিনি বা ফ্রুকটোজজাতীয় খাবার খাওয়া হয়, তখন মস্তিষ্কে সেই নিউরনের পুনর্বিন্যাসও ইঙ্গিত দেয় বেশি বেশি মিষ্টি বা চিনি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ফলে আস্তে আস্তে এটি একটি এডিকশন তৈরি করে।

যেহেতু চিনি স্বাদ বাড়ানোর কাজটি করে, তাই ব্রেইনে প্রি ফ্রন্টাল কর্টেক্সে ইনহিবিটারী নিউরন সিদ্ধান্ত নেয় ডায়েট বা ব্যায়াম না করে উল্টো বেশি বেশি মিষ্টি খাওয়ার। ফলে দেহে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক ইউসিএলএ সমীক্ষা অনুসারে চিনি ব্রেইনে ফ্রি রেডিক্যাল গঠন করে। যেটি মনোযোগ ও শেখার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটায়। স্মৃতিশক্তি খারাপ করাসহ মস্তিষ্কের ঘনত্বের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।

মেমরি রিসেপ্টরগুলোও ব্লক করে দেয়। চিকিৎসকদের ভাষায়, চিনি মস্তিষ্কে আলফা, ডেলটা ও থেটা ব্রেইন ওয়েভ বাড়িয়ে দিয়ে স্নায়ুবিক ভারসাম্য নষ্ট করে, ব্রেইনের মেসোলিম্বিক ডোপামিন সিস্টেমের স্তর উঁচু করে দেহের ভারসাম্য নষ্ট করে।

এছাড়া চিনি মেজাজেরও পরিবর্তন ঘটায়। ব্রেইন ডেমেজ, মাইগ্রেন, মস্তিষ্কের নিউরন, কোষ এবং উন্নতি বন্ধ করাসহ বিভিন্নভাবে ক্ষতি করছে এই চিনি। তবে আবার একেবারেই চিনি খাওয়া বন্ধ করা উচিত নয়, বরং অল্প পরিমাণেই খাওয়া শ্রেয়।

অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে ব্রেইন আয়তনে সংকুচিত হয়ে যায় এবং স্মৃতিশক্তিকে প্রভাবিত করে। এই কারণে ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের পার্কিনসন, আলঝেইমার বা ডিমেনশিয়ার মতো রোগ হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।

অতিরিক্ত চিনি, ব্রেইনের হিপ্পোক্যাম্পাস এবং অন্যান্য অংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে, আমাদের সামগ্রিক মুডকে নিয়ন্ত্রণ করে। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত মানুষেরা যেমন মিষ্টির প্রতি বেশি আসক্ত হয়, তেমনি মিষ্টি জাতীয় খাবার এই রোগগুলোকে বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দিতে পারে।

অতিরিক্ত চিনি বয়ে আনতে পারে একাধিক শারীরিক সমস্যা। বাড়তে পারে ওজন। অতিরিক্ত চিনি খেলে, বিশেষ করে চিনিযুক্ত পানীয় থেকে ওজন বাড়ার ঝুঁকি থাকে।

হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়তে পারে। বেশি চিনি খাওয়া, হৃদরোগের ঝুঁকির কারণগুলি যেমন স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ এবং প্রদাহ বৃদ্ধি করে। উচ্চ-চিনিযুক্ত ডায়েটে হৃদরোগ থেকে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে।

বেশি চিনিযুক্ত খাবারগুলো এন্ড্রোজেন নিঃসরণ, তেলের উৎপাদন এবং প্রদাহ বৃদ্ধি করতে পারে, যা আপনার ব্রণ হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে।

উচ্চ-চিনিযুক্ত খাদ্য স্থূলতা এবং ইনসুলিন প্রতিরোধের দিকে পরিচালিত করতে পারে, উভয়ই টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকির কারণ।

অত্যধিক চিনি স্থূলতা, ইনসুলিন প্রতিরোধ এবং প্রদাহ হতে পারে, এগুলো সবই ক্যানসারের ঝুঁকির কারণ।

চিনিযুক্ত খাবার ত্বকের বার্ধক্য এবং বলিরেখা গঠন দ্রুত করতে পারে। খুব বেশি চিনি খাওয়ার ফলে টেলোমেরেস সংক্ষিপ্ত হতে পারে, যা কোষের বার্ধক্য বাড়ায়।

বেশি চিনিযুক্ত খাবারে রক্তে শর্করার বৃদ্ধি হয়। যা আপনার শক্তির মাত্রাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে এবং তারপরে শরীর ভেঙে পড়ে।

অত্যধিক চিনি খাওয়ার ফলে এনএএফএলডি হতে পারে। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে লিভারে অতিরিক্ত চর্বি তৈরি হয়।

চিনি বা অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া বাদ দিতে হবে। কারণ অতিরিক্ত চিনি খেলে মস্তিষ্কে এক বিশেষ ধরনের প্রোটিনের কার্যকারিতা বন্ধ করে দেয়। যেটি মস্তিষ্কে ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ প্রতিরোধে সহায়তা করে এবং স্মৃতিনাশের ঝুঁকি কমায়। রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে গেলে প্রোটিন গ্লাইকেশন বাধা পায়। এছাড়া মস্তিষ্কে অ্যাবনর্মাল প্রোটিন তৈরি হওয়া অ্যালঝেইমার্সের কারণ।

অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়ার অভ্যাস থাকলে অন্ত্রে খারাপ ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো অনেক সময় মস্তিষ্কের প্রদাহ বা রোগের কারণ হয়। গবেষকরা বলেছেন, মানুষের অন্ত্রে ভালো ও খারাপ উভয় ব্যাকটেরিয়াই থাকে। ভালো ব্যাকটেরিয়ার কাজ হলো খাবার পরিপাকে সহায়তা করা। বাইরের খাবার, তেল বা মসলাদার খাবার, চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার খেলে অন্ত্রে খারাপ ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়। এগুলো খাদ্যনালীতে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খেলে প্যারাব্যাকটেরয়েডের জন্ম হয়। এরা ধীরে ধীরে সংখ্যায় বাড়তে থাকে। আর যেগুলো আগে থেকে অন্ত্রে অবস্থান করে সেগুলো চরিত্রে পরিবর্তন আনে। ফলে জটিল রোগের সৃষ্টি হয়।

পুরুষদের খাদ্যাভাসে চিনির পরিমাণ বেশি হলে কমতে পারে শুক্রাণুর মান। তাই অতিরিক্ত চিনি খেলে ধীরে ধীরে পুরুষের বন্ধ্যত্বের সমস্যা দেখা দিতে পারে। গবেষণা থেকে জানা যায়, খাদ্যাভাসে চিনির পরিমাণ অতিরিক্ত হলে পুরুষের শুক্রাণুর মান কমতে থাকে।

চিনির প্রতি তীব্র মোহ কমাতে চিনির বিকল্প বেছে নিতে হবে। সাদা চিনি খাওয়া একেবারেই বাদ দিন। লাল চিনি সাদা চিনির থেকে কম ক্ষতিকর। এছাড়া মিষ্টি ফল, ফলের সালাদ বা কাস্টার্ড ভালো সমাধান। খেজুর, মধু, গুড়, কিশমিশ, জাইলিটল খেয়েও কিন্তু মিষ্টির মোহ কমাতে পারেন, যা ততটা ক্ষতিকরও নয়। তবে কৃত্রিম চিনি কোনোভাবেই খাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক চিনি, যেমন স্টেভিয়া পাতা খেতে পারেন, যা চিনির স্বাদ দেবে কিন্তু চিনির মতো ক্ষতিকর নয়। সুস্থ থাকতে হলে ধীরে ধীরে খাবার তালিকা থেকে চিনিজাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে। অতিরিক্ত চিনি খাওয়া বাদ দিলে যৌবন দীর্ঘস্থায়ী হবে।

ADS ADS

প্রতিছবি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Comments: