শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম কী বলে
১ মে শ্রমিক দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে আসছে এ দিনটি। ইসলাম এমন একটি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার শিক্ষা দেয় যেখানে মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক থাকে আন্তরিকতাপূর্ণ। শ্রমিক-মালিকের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে এমনই একটি শান্তিময় পরিবেশ গড়ে ওঠে যেখানে একে অপর যেন ভাই ভাই রূপ ধারণ করে।
ইসলাম যেহেতু শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম তাই যা কিছুতে শান্তি ও কল্যাণ আছে তা-ই ইসলাম করতে উৎসাহিত করে। ইসলাম কখনো এ শিক্ষা দেয় না, জোর-জুলুম করে অপরের মাল ভক্ষণ কর বা কারও অধিকার বঞ্চিত কর। পরিশ্রম করে হালাল উপার্জনকে ইসলাম অনেক গুরুত্ব দিয়েছে।
ইসলামের শিক্ষা হলো পরিশ্রম করে হালাল পথে যে সম্পদ অর্জিত করা হয় তার মাঝেই প্রভূত কল্যাণ নিহিত। নিজের শ্রম দিয়ে হালালভাবে উপার্জন করার শিক্ষাই পবিত্র কোরআন ও বিশ্বনবি (সা.) আমাদের দান করেছেন।
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে ‘যখন নামাজ পড়া সমাপ্ত হয়ে যায়, তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) অনুসন্ধান কর’ (সূরা জুময়া : আয়াত ১০)। আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা শুধু ইবাদত করার জন্যই বলেননি বরং বলা হয়েছে নামাজ শেষ করে জমিনে চলে যাওযার জন্য অর্থাৎ জীবিকার সন্ধান করার জন্য।
মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমজীবীর উপার্জনই উৎকৃষ্টতর যদি তা সৎ উপার্জনশীল হয়’ (মুসনাদ আহমদ)। মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের শ্রমের ওপর জীবিকা নির্বাহ করে তার চেয়ে উত্তম আহার আর কেউ করে না। জেনে রাখ, আল্লাহর নবি দাউদ (আ.) নিজের শ্রমলব্ধ উপার্জনে জীবিকা চালাতেন’ (বুখারি, মেশকাত)।
একজন সৎকর্মী শ্রমিক যখন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসে তখন আল্লাহপাক তার প্রতি এতই সন্তুষ্ট হন যে, তার গোনাহ মাফ করে দেন। এ ব্যাপারে হাদিসে উল্লেখ আছে যে, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শ্রমজনিত কারণে ক্লান্ত সন্ধ্যা যাপন করে সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েই তার সন্ধ্যা অতিবাহিত করে’ (তিবরানি)। একজন সৎকর্মশীল শ্রমিকের জন্য এর চেয়ে আনন্দ ও আশার বাণী আর কী হতে পারে?
ইসলাম যেমনভাবে শ্রমের প্রতি উৎসাহ জুগিয়েছে এবং একে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেছে তেমনিভাবে কাজকর্ম না করে সমাজ ও দেশের বোঝা হয়ে থাকাকে খুবই অপছন্দ করে। এছাড়া পরিশ্রম না করে ভিক্ষার হাত প্রসারিত করাকেও ইসলাম অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায় হিসাবে অভিহিত করেছে। মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করবে সে আল্লাহর সঙ্গে এমনভাবে সাক্ষাৎ করবে যে, তার চেহারায় এক টুকরা গোশতও থাকবে না’ (বুখারি, মুসলিম)। এ ছাড়া ভিক্ষালব্ধ খাদ্যকে নবি করিম (সা.) ‘অগ্নিদগ্ধ পাথর বলে অভিহিত করেছেন’ (মুসলিম)।
তাই পবিত্র ধর্ম ইসলামে শ্রমিকের কাজকে সর্বোচ্চ মূল্য দেওয়া হয়েছে। হজরত রাসূলে পাক (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তার মজুরি পরিশোধ কর।’ ‘শ্রমিক-মালিক ভাই ভাই, মালিকের রক্ষক হলো শ্রমিক। শ্রমিকের প্রতি জুলুম করা হলে ভয়াবহ অভিশাপ লাগবে।’ তিনি (সা.) আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজে নিজে রোজগার করে জীবন পরিচালনা করেন, আল্লাহ তার প্রতি খুশি। একবার হজরত রাসূলে করিম (সা.)-এর কাছে কোনো এক সাহাবা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কোন ধরনের উপার্জন শ্রেষ্ঠতর? উত্তরে তিনি (সা.) বললেন, নিজের শ্রম দ্বারা অর্জিত উপার্জন।
আজ আমরা দেখতে পাই শ্রমিকরা তাদের শ্রম ঠিকই দিচ্ছেন কিন্তু মালিক পক্ষ সঠিক পারশ্রমিক দিচ্ছেন না আর এর ফলে বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত দাঙ্গা-হাঙ্গামা হচ্ছে।
ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা পৃথিবীর সব রকমের সমস্যার প্রকৃত সমাধান এখানে রয়েছে। ইসলাম তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ গঠন করতে মানুষকে শিক্ষা দিয়ে আসছে। আর ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হলো ন্যায়বিচার এবং শ্রমিকের মর্যাদাকে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। ইসলামের দৃষ্টিতে একজন শ্রমিক মালিকের কাজের দায়িত্ব নিয়ে এমন এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, যা শুধু তার সংসার নির্বাহের জন্য নয় বরং আখেরাতের সফলতা অর্জন করার ক্ষেত্রেও এ দায়িত্ব বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
তাই ইসলামে মালিক ও শ্রমিকের ওপর আবশ্যক বিধিমালা উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করেছে। কেননা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমেই যে কোনো বিষয়ে সঠিক ফয়সালা হতে পারে। শ্রমিকদের সম্পর্কে হজরত রাসূল (সা.) বলেছেন, যার মধ্যে আমানতদারি নেই তার মধ্যে ইমানও নেই। সুতরাং শ্রমিকের উচিত, তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য বিশ্বস্ততার সঙ্গে সুসম্পন্ন করা।
শ্রমিক ভাইদেরও কিছু গুণ থাকা চাই, যেমন শক্তি, যোগ্যতা, সততা ও আমানতদারি। কোনো শ্রমিক যদি তার অপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করে মজুরি আদায় করে তাহলে হাশরের ময়দানে তাকে কঠিনভাবে আল্লাহপাকের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। অপরদিকে শ্রমিকের প্রতি মালিককে পরম সহানুভূতিশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে শরিয়ত। হজরত রাসূলে করিম (সা.) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শ্রমিককে দিনে সত্তরবার হলেও ক্ষমা করো।’
মালিকদের উচিত সব সময় শ্রমিকদের খোঁজখবর নেওয়া, তাদের সুখ-দুঃখে পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। আল্লাহতায়ালা আমাদের প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা অনুসরণ করে জীবন পরিচালনার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রতিছবি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
Comments: