ইন্টারনেট
ADS

আজকের দিনটি দেশের জনগণের জন্য একটা গর্বের দিন: প্রধানমন্ত্রী

11 November 2023, 11:38:35

প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারবাসীকে দেওয়া কথা রেখেছেন জানিয়ে বলেন, ‘দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে সত্যি আমি খুব আনন্দিত। একটা কথা দিয়েছিলাম, কথাটা রাখলাম। আজকের দিনটি দেশের জনগণের জন্য একটা গর্বের দিন। ক্ষমতার লোভে দেশের সম্পদ কারও হাতে তুলে দিতে রাজি নই।’

শনিবার (১১ নভেম্বর) দুপুরে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন চত্বরে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্পের রেল চলাচলের উদ্বোধন অনুষ্ঠান ও মাতারবাড়ি টাউনশিপ মাঠে আয়োজিত জনসভায় এসব প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন কালে তিনি এ কথা বলেন।

ওইদিন কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনে সুধী সমাবেশে অংশগ্রহণ, ট্রেনে চড়ে রামু সফর, ৭টি বড় প্রকল্পসহ ১৫টি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ৪টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এর মধ্যে রয়েছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প, মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর চ্যানেল, সাব মেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে কুতুবদিয়ার দ্বীপকে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডে সংযুক্তকরণ, বাঁকখালী নদীর ওপর কস্তুরাঘাট- খুরুশকুল সংযোগ সেতু, কক্সবাজার বিমানবন্দরের ভূমি ভরাট, প্রোটেকশন বাঁধ নির্মাণ, অ্যাপ্রোচ রোড ও সৌন্দর্যবর্ধন কাজ, উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ডিজাইন ও স্থাপনকরণ, মহেশখালী গোরকঘাটা-শাপলাপুর জনতা বাজার সড়কের মজবুত ও প্রশস্তকরণ প্রকল্প, রামু কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কুতুবদিয়ায় কৈয়ারবিল আরসিসি গার্ডার ব্রিজ, চকরিয়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল হামিদ পৌর বাস টার্মিনাল সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন, ঈদগাঁও জাহানারা ইসলাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন, মহেশখালী ইউনুচখালী নাছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডিমিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প ও উখিয়া রত্নাপালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় একাডেমিক ভবন নির্মাণ, মরিচ্যা পালং উচ্চ বিদ্যায়য়ের একাডেমিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প।

এসব প্রকল্প ছাড়াও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পের প্রথম টার্মিনাল নিমার্ণ, টেকনাফ মাল্টিপারপাস ডিজাস্টার রিসিলেন্ট শেল্টার কাম আইসোলেশন সেন্টার নির্মাণ, রামু উপজেলা জোয়ারিয়ানালা-নন্দাখালী সড়কে ১৮৪ মিটার দীর্ঘ গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ ও কক্সবাজার সদরে কাব স্কাউটিং সম্প্রসারণ ( ৪র্থ পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় ভবন নির্মাণ প্রকল্পসহ চারটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদাররা অগ্নিসংযোগ করে মানুষের ঘড়বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘জাতির পিতা ধ্বংসের ওপর দাঁড়িয়ে দেশ গড়ার কাজে হাত দিয়েছিলেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘সড়ক যোগাযোগ ও মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়নে বর্তমান সরকার কাজ করছে। রেল সম্পূর্ণ অবহেলিত ছিল। লাভ-লোকসানের হিসাব না করে এগিয়ে নেয় বর্তমান সরকার।’

মাতারবাড়ী চ্যানেলের নীল জলরাশিতে গভীর সমুদ্র বন্দর:

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর চ্যানেলের নীল জলরাশিতে বিস্ময় ব্যবসায়ীদের চোখেমুখে। সেই নীল জলের রূপে স্বপ্ন বুনছেন ব্লু ইকোনমির। কৌতূহল ছিল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চিমনিকে ঘিরেও। পাশে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জেটি। সেই জেটিতে ভিড়েছে কয়লা ও প্রকল্পের পণ্যসামগ্রী নিয়ে আসা শতাধিক বড় বড় জাহাজ।

মাতারবাড়ী বন্দরের প্রথম প্রকল্প পরিচালক মো. জাফর আলম বলেন, আজ আমার জন্য আনন্দের দিন। বাংলাদেশের জন্য গভীর সমুদ্র বন্দর প্রয়োজন ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গভীর সমুদ্রবন্দর করে মেরিটাইম বিশ্বে নতুন ইতিহাস গড়েছেন। মাতারবাড়ীর যেখানে এখন কয়লা জেটি হয়েছে সে জায়গাটি ১০ মিটার নিচে ছিল। অনেক চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে এখন মাতারবাড়ী চ্যানেল শুধু দৃশ্যমান নয়, শতাধিক জাহাজও সফলভাবে ভিড়েছে।

বাফার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শিপিং এজেন্ট অ্যাসোাসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। এটি অপার সম্ভাবনাময় উদ্যোগ ব্যবসায়ীদের জন্য। কনটেইনারে পণ্য আমদানি রপ্তানিতে সিঙ্গাপুর, কলম্বোতে ট্রান্সশিপমেন্ট জট, সময় ও ব্যয় থাকবে না। ব্যবসায়ীরা বিদেশি প্রতিযোগীদের সঙ্গে টিকে থাকতে সুযোগ চায়। সময় ও ব্যয় কমাতে চায়। প্রতিবেশী দেশগুলোর ট্রান্সশিপমেন্ট কার্গো সাপোর্ট পেলে এটি দ্রুত আঞ্চলিক হাব হবে।

শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আরিফ বলেন, মেরিটাইম বিশ্বে নতুন দিগন্ত মাতারবাড়ী। ২০২৬ সালের পর বাংলাদেশের আমদানি রপ্তানিকারকদের ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট ইউজ করতে হবে না। ইউরোপ আমেরিকা থেকে সরাসরি বড় জাহাজ ভিড়বে মাতারবাড়ী। বড় বড় জাহাজে পণ্য ও কনটেইনার আনলে সময় ও ব্যয় কমে যায়। আমদানি রপ্তানিকারকরা এটি চায়।
দেশের প্রথম ও একমাত্র গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের জন্য ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা প্রাক্বলিত ব্যয়ে মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের ৮ হাজার ৯৫৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা, সওজের ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। জাইকা, সরকার ও চবক এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে ৩৫০ মিটার প্রশস্ত ও ১৬ মিটার গভীরতা সম্পন্ন ১৪ দশমিক ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ চ্যানেলের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। অ্যাপ্রোচ চ্যানেলের উত্তর পাশে ২ হাজার ১৫০ মিটার দীর্ঘ ও দক্ষিণ পাশে ৬৭০ মিটার দীর্ঘ ব্রেক ওয়াটার (ঢেউ নিরোধক বাঁধ) নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে আনুমানিক ০.৬ থেকে ১.১ মিলিয়ন টিইইউস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কনটেইনার) এবং ২০৪১ সালের মধ্যে আনুমানিক ২.২ থেকে ২.৬ মিলিয়ন টিইইউস কন্টেইনার কার্গো হ্যান্ডেল করা সম্ভব হবে।

প্রকল্পের সড়ক ও জনপথ অংশে ২৭ দশমিক ৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে মাতারবাড়ি বন্দরের সঙ্গে ন্যাশনাল হাইওয়ের সংযোগ স্থাপন করার কাজ চলছে। মাতারবাড়ী বন্দরকে ঘিরে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ আবর্তিত হবে তা বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা জিডিপিতে ২-৩ শতাংশ অবদান রাখবে। ২০২৬ সালে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে।

কক্সবাজারে রেলের হুইসেল বাজালেন প্রধানমন্ত্রী:

১৩৩ বছরের স্বপ্ন অবশেষে হাতের মুঠোয় এসেছে কক্সবাজারবাসীর। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ট্রেনের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার বেলা ১২টা ৫৮ মিনিটে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ উদ্বোধন করেন। এরপর দুপুর ১টা ২৪ মিনিটে ট্রেনের হুইসেল বাজান প্রধানমন্ত্রী।

এসময় প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, স্থানীয় সংসদ সদস্য, রেলের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ অন্যান্যরা।

কক্সবাজারের সঙ্গে রেল সংযোগ করতে পেরে খুব আনন্দিত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার উদ্বোধনী বক্তব্যেও শুরুতেই বলেন, আজ কক্সবাজারবাসীর জন্য একটি আনন্দের দিন, রেল যোগাযোগ স্থাপন হলো। এই কক্সবাজার এমন একটি সমুদ্র সৈকত যা বিশ্বে বিরল। বিশ্বের সব থেকে দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকত, ৮০ মাইল লম্বা। পৃথিবীতে এমন দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকত আর কোথাও নেই। বর্তমান সরকারের সময় রেলকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয় তুলে ধরে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রসঙ্গ তিনি উল্লেখ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যমুনা নদীর ওপর আলাদা রেল সেতু করে দিচ্ছি। এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে, না বলে পারছি না। ১৯৯৬ সালে আমরা ক্ষমতায় এসে যখন যমুনা নদীর ওপর সেতু করি তার আগে থেকেই আমাদের দাবি ছিল এখানে রেল সংযোগটা থাকতে হবে। কিন্তু ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে শুরু করে অনেকেই আপত্তি করেছিল যে, এই রেল ভায়াবল হবে না।

মজার ব্যাপারটা হচ্ছে এখন এতোই ভায়াবল সেই ওয়ার্ল্ড ব্যাংকই আমাদের প্রস্তাব দিল যে, তারা যমুনা নদীর ওপর আলাদা রেল সেতু করে দেবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম, বাংলাদেশটা আমাদের আমরা জানি কি উন্নতি করতে হবে। ওই একজন দুইজন বাইরের থেকে এসে আমাদের ওপর খবরদারি, অনেকে পরামর্শ দেবে সেটা আর হবে না। আজকে তাদেরই অর্থে আমরা যমুনা নদীর ওপর রেল সেতু করে দিচ্ছি।

কক্সবাজারবাসী উচ্ছ্বসিত নিজের নগরীতে ট্রেন চলাচলে:

কক্সবাজারের চকোরিয়ার বাসিন্দা ৫৫ বছর বয়সী আব্দুল করিম বলেন, ‘আঁর (আমার) দাদার মুখত (মুখে) তো শুনিতাম, রেললাইন আইবোঁ, এতদিন নআইয়ে( আসেনি)। এহন আঁরার(আমাদের) স্বপ্ন পূরণ হইব।’

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য এই প্রকল্প যেন সোনায় সোহাগা। কক্সবাজারে ‘টং’ দোকানের ম্যানেজার রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘আরারত্তুন বেজ্ঞল্লাত্তু সুবিধা থাকিউম।’

কক্সবাজার সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান শরমিন সিদ্দিকা লিমা বলেন, কক্সবাজারের রেলসংযোগ তার মতো কর্মজীবীদের যোগাযোগ সহজ করেছে। অনেকেই জেলার বাইরে গেলে কীভাবে যাবে-একটা দুশ্চিন্তা ভর করতো।

কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু ও ঈদগাঁও) আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, কক্সবাজারে আমাদের চৌদ্দগোষ্ঠী রেল দেখবে ভাবেনি। কক্সবাজারের এসব মানুষের সন্দেহভরা উচ্ছ্বাসের পিছনে রয়েছে ১৩৩ বছরেও কক্সবাজার রেলপথ না আসার বাস্তবতা।

১৮৯০ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রথম পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের (সাবেক বার্মা) আকিয়াব বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ। তারপর ১৯১৭ থেকে ১৯২১ সালে চট্টগ্রাম-দোহাজারী পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে পরিকল্পনা অনুসারে কক্সবাজার পর্যন্ত বাদবাকি অংশে রেলপথ তৈরি হয়নি।

এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্তে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ স্থাপনে জন্য ২০১০ সালে প্রথম প্রকল্প নেওয়া হয়। শুরুতে এটি ছিল ‘দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ’ প্রকল্প। এতে মোট ১২৯ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণের কথা ছিল। পরে রামু থেকে ঘুমধুম অংশের কাজ স্থগিত করা হয়। এখন চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ সমাপ্ত হলো।

মোট ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। বাকি ৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে।

প্রকল্পের জন্য কক্সবাজার জেলায় ১ হাজার ৩৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে নয়টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট এবং ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট। তারপর চলতি বছরের আগস্ট মাসের শুরুতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢলে রেললাইনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারজন্য এ প্রকল্প আরও পিছিয়ে যায় কয়েক মাস।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারে ঝিনুকের আদলে আধুনিক রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণের পাশাপাশি দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মোট ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সংরক্ষিত বন এলাকায় রেললাইন স্থাপন করায় বন্যহাতি ও বন্যপ্রাণী চলাচলের জন্য ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, জেলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর দৃশ্যমান আইকনিক রেল স্টেশন। ঝিনুকের আদলে তৈরি দৃষ্টিনন্দন এ স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা বিশিষ্ট স্টেশনটি নির্মাণে বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। চার বছরের শ্রমে আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটি আজ সত্যিই চোখ জুড়ানো বাস্তবতা।

এরপরের চ্যালেঞ্জ মায়ানমারের আপত্তি নিষ্পত্তি করে ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণের মাধ্যমে চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে রেলপথ চালু। এর ফলে বিনিয়োগ-শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক বন্ধন সহজতর হয়ে উঠবে। কৃষি-খামার ও শিল্পকারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বাজারজাত এবং রফতানি সুবিধার প্রসার ঘটবে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের জনসাধারণের কর্মচাঞ্চল্য ও সচ্ছলতা বৃদ্ধি পাবে।

নজর কাড়া আইকনিক রেল স্টেশনে যা থাকছে:

দৃষ্টিনন্দন এ রেল স্টেশনটি দেখলে যে কারো মন জুড়িয়ে যায়। বিশালাকার এ স্টেশনের ঠিক মাঝখানে বসানো হয়েছে ঝিনুক আর সেই ঝিনুকের পেটে মুক্তা মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে দর্শনার্থীদের। সবকিছু মিলে এক অন্যরকম শিহরণ জাগায় দেশের প্রথম আইকনিক রেল স্টেশন। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আন্তর্জাতিকমানের সব ধরনের সুবিধা রেখেই এই স্টেশন নির্মাণ করা হয়। আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় ভরপুর, অনন্য নির্মাণশৈলীতে গড়ে তোলা স্টেশনটি দেখলেই পর্যটকদের নজর কাড়বে।

কক্সবাজার শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়ায় ঝিনুক স্টেশন। ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম থেকে সকালে ট্রেনে উঠে দুপুরে কক্সবাজারে নেমে সমুদ্রসৈকতে ঘোরাঘুরি শেষে যে কেউ রাতের ট্রেনে আবার ফিরতে পারবেন।

এ জন্য মূল্যবান জিনিসপত্র স্টেশনের লকারে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। কেউ থাকতে চাইলে থাকার ব্যবস্থাও আছে। গত ২ নভেম্বর দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে প্রথম ট্রেন পরিদর্শন ট্রেন আইকনিক রেল স্টেশনে এসেছে। ওইদিন সন্ধ্যায় হুইসেল বাজিয়ে আটটি বগি নিয়ে প্রথম ট্রেনটি যখন ঢুকে তখন মানুষের আনন্দের শেষ নেই।

সমুদ্রসৈকত থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ২৯ একর জমির ওপর সামুদ্রিক ঝিনুকের আদলে নির্মিত দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২১৫ কোটি টাকা। রেলস্টেশন ভবনটি এক লাখ ৮৭ হাজার ৩৭ বর্গফুটের। সারা বিশ্বের পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামোর পাশাপাশি একজন পর্যটককে যেন ভ্রমণ-সংক্রান্ত কোনো জটিলতায় পড়তে না হয়, বেড়াতে এসে বাড়তি খরচ না করতে হয়, সেসব দিকে লক্ষ রেখেই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা রাখা হচ্ছে। রেলওয়ে স্টেশনটি নির্মাণের পর পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন ৪৬ হাজার যাত্রী কক্সবাজারে যাতায়াত করতে পারবেন।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলেন, ছয়তলা বিশিষ্ট স্টেশনটি নির্মাণে চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ জন বিদেশিসহ মোট ২৫০ জন প্রকৌশলী এবং ছয় শতাধিক লোক কাজ করছে। চার বছরের শ্রমে আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটি দৃশ্যমান হয়েছে। মূল ভবনের সামনে তৈরি করা হয়েছে ঝিনুকাকৃতির দৃষ্টিনন্দন একটি ফোয়ারা। ঝিনুকের ভেতরে মুক্তা। যাত্রীরা ঝিনুক ফোয়ারা দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করবেন। তারপর চলন্ত সিঁড়ির মাধ্যমে পদচারী–সেতু হয়ে উঠবেন ট্রেনে। আবার ট্রেন থেকে নেমে ভিন্ন পথে বেরিয়ে যাত্রীরা ছুটবেন পর্যটন শহরে। ভবনের পূর্ব পাশে ৮০ ফুট লম্বা পদচারী সেতু। এর সঙ্গে পৃথক তিনটি চলন্ত সিঁড়ি। বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। ভবনের উত্তরে ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থের তিনটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। সেখানে অপেক্ষামান যাত্রীদের জন্য বসার ব্যবস্থা রয়েছে।

দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলেন, মূল ভবনের নিচতলায় থাকবে টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনাকক্ষ, লকার, তথ্যকেন্দ্র, মসজিদ, শিশুদের বিনোদনের জায়গা, প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ ও পদচারী–সেতুতে যাতায়াতের পথ। দ্বিতীয় তলায় থাকবে শপিং মল, শিশু যত্নকেন্দ্র, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। তৃতীয় তলায় ৩৯ কক্ষবিশিষ্ট তারকা মানের হোটেল, চতুর্থ তলায় রেস্তোরাঁ, শিশু যত্নকেন্দ্র, কনফারেন্স হল ও কর্মকর্তাদের কার্যালয়।

ট্রেনের টিকিট কেকে কক্সবাজার থেকে রামু গেলেন প্রধানমন্ত্রী:

দোহাজারী-কক্সবাজার রুটে বহুল প্রতীক্ষিত রেল চলাচল উদ্বোধনের পর কক্সবাজারের রেলওয়ে স্টেশনে নিজের হাতে ট্রেনের টিকিট কাটেন প্রধানমন্ত্রী। পরে কক্সবাজার স্টেশন থেকে রামু স্টেশনে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এরপর সবুজ পতাকা নেড়ে এবং হুইসেল বাজিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই রুটে ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করেন তিনি। ১টা ২৮ মিনিটে ট্রেনটি প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে কক্সবাজার রেল স্টেশন থেকে রামু রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। দুপুর ১টা ৫৩ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী রামু স্টেশনে পৌঁছান। ট্রেনযাত্রায় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, কৃষক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

যাত্রার সময় প্রধানমন্ত্রী ট্রেনটির বিভিন্ন বগি ঘুরে ঘুরে দেখেন এবং সফরসঙ্গীদের খোঁজখবর নেন। এর আগে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নবনির্মিত ১০২ কিলোমিটার রেললাইন এবং এই রুটে ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সেখান থেকে মাতারবাড়ি যান।

ওই কর্মসূচিতে যোগদানের পর প্রধানমন্ত্রী আকাশপথে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরে গেছেন।

ADS ADS

প্রতিছবি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Comments: