ইন্টারনেট
হোম / অর্থনীতি / বিস্তারিত
ADS

শুল্ক কমিয়ে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের চিন্তা

22 August 2022, 11:05:23

আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে গত ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করার পর এর প্রভাব পড়ে সব খাতে। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ৯ মাসের মাথায় ফের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশে, যা গত নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ্।

মূল্যবৃদ্ধির বিশ্লেষণে দেখা যায়, জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। বলা হয়েছিল আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে সমন্বয় করা হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলের দামের ওঠা-নামার মধ্যে দাম সমন্বয় করলে তা অস্থিতিশীলতার কারণ হতে পারে।

এমন অবস্থায় জ্বালানি তেলে আরোপিত শুল্ক কমিয়ে বা প্রত্যাহার করে সমন্বয়ের মাধ্যমেই সংকট নিরসন হবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

জ্বালানি ও খনিজ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম কমানোর প্রস্তাব তৈরি করতে এরই মধ্যে বিপিসি ও পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। আমদানি খাতে ভ্যাট ও ট্যাক্স কতটা কমিয়ে কীভাবে তা মানুষের আয়ত্তে রাখা যায়, তার বিস্তারিত তুলে ধরতে বলা হয়েছে।

গত ১১ আগস্ট জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরতে জ্বালানি বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, তেল পাচার ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) লোকসানের হাত থেতে বাঁচাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। আইএমএফ কোনো দেশকে ঋণ দেওয়ার আগে কঠোর শর্ত আরোপ করে- এমনটাই প্রচলিত। ঋণ পাওয়ার জন্য সরকার জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করে দিয়েছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ৩৬ শতাংশ ভর্তুকি প্রত্যাহারের ফলে ভোক্তাপর্যায়ে বেড়ে গেছে তেলের দাম।

তবে এক ধাক্কায় প্রায় শতাংশ দাম বাড়ানোর ফলে জীবনযাত্রায় বেড়ে যায় অসহনীয় চাপ। হুট করে এমন দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াকে অযৌক্তিক মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাড়তি এ আর্থিক চাপের ফলে শিল্প উৎপাদনে বেড়েছে অতিরিক্ত খরচ। রফতানি আদেশ কমে গেছে, ফলে রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা রয়েছে হুমকির মুখে।

এছাড়া পরিবহন খরচ বৃদ্ধির ফলে কাঁচামাল ও অন্যান্য দ্রব্যমূল্যের দাম লাগামছাড়া। প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষিকাজে অতিরিক্ত ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।

সমালোচনার মুখে জ্বালানি ও খনিজ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে এলে দেশের বাজারে দাম সমন্বয় করা হবে।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমও বলেন, প্রয়োজন হলে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নেয়া হবে পদক্ষেপ।

গত কয়েক দিন ধরে বিশ্বাবাজারে পড়তির মুখে ছিল জ্বালানি তেলের দাম। সবশেষ পরিশোধিত তেলের দাম নেমে আসে ব্যারেলপ্রতি ৮৮ দশমিক ১১ মার্কিন ডলারে। একই সময়ে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৯১ দশমিক ৫১ ডলারে নামে, যা গত ৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

তবে বিপিসি জানায়, ব্যারেলপ্রতি দাম ৮০ ডলারের উপরে চলে গেলে তাদের লোকসান গুনতে হয়। হ্রাসকৃত দামের তেল সেপ্টেবর মাসে অর্ডার করা হবে। ফলে অক্টোবর নাগাদ ধীরে ধীরে কমতে পারে জ্বালানি তেলের মূল্য।

জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। যার বাস্তবায়ন করা হলে স্বাভাবিক হতে পারে জ্বালানি পরিস্থিতি।

শুল্ক প্রত্যাহার

জ্বালানি তেলে আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বাবদ প্রায় ৩৭ শতাংশ কর দিতে হয়। জ্বালানি বিভাগের এক হিসাবে, বর্তমানে ১১৪ টাকা প্রতি লিটার ডিজেলের মধ্যে ১৬ টাকা ১৪ পয়সা ভ্যাট পরিশোধ করছেন ক্রেতারা। আয়কর বাবদ প্রতি লিটারে আরও ১৮ টাকা কর দিতে হয়।

এছাড়া সরকার কর্তৃক তেল আমদানিতে গড়ে ৩২ শতাংশ শুল্ক ও ভ্যাট রয়েছে। প্রতি লিটার তেলে বর্তমানে ট্যাক্স রয়েছে ৩৬ টাকা। শুল্ক প্রত্যাহার হলে তেলের দাম ৩৬ টাকা পর্যন্ত কমে যেতে পারে বলে জানা গেছে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জ্বালানি তেলের দাম কমানোর প্রস্তাব তৈরি করতে এরই মধ্যে বিপিসি ও পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। আমদানি খাতে ভ্যাট ও ট্যাক্স কতটা কমিয়ে কীভাবে তা মানুষের আয়ত্তে রাখা যায়, তার বিস্তারিত তুলে ধরতে বলা হয়েছে।

সূত্রে আরো জানা যায়, ইতোমধ্যে প্রাথমিকভাবে আয়কর ও ভ্যাটের নতুন হার ঠিক করা হয়েছে। শিগগির পুনর্নির্ধারিত হার কার্যকরের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এনবিআরকে অনুরোধ করা হবে।

যদিও গত বছর সেপ্টেম্বরে জ্বালানি বিভাগ আয়কর ও ভ্যাট পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু তা গ্রহণ করেনি এনবিআর। ওই সময় আয়কর ও ভ্যাট শতাংশের পরিবর্তে নির্দিষ্ট করার প্রস্তাব করে জ্বালানি বিভাগ। কারণ, জ্বালানি তেলের দাম সব সময় ওঠানামা করে। দাম বাড়লে আয়কর ও ভ্যাট বাবদ খরচ বেড়ে যায়।

রাশিয়া থেকে ‘রুবল’ এ তেল আমদানি

জ্বালানি তেলের সংকটে রাশিয়া থেকে তেল কেনার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়টি পর্যালোচনার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর।

বাংলাদেশ পেট্রেলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা যায়, রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান রসনেফট চট্টগ্রাম সমুদবন্দর পর্যন্ত প্রতি ব্যারেল ডিজেল ৫৯ ডলারে বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করতে ইচ্ছুক। এছাড়া তুরস্কভিত্তিক তাতারস্তান ট্রেডার্স জিটুজি ভিত্তিতে ক্রুড অয়েল বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে। জানা গেছে, বিপিসি এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ক যাবতীয় প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে।

জানা গেছে, টাকার বিপরীতে বর্তমানে রুবলের মান ১ টাকা ৬০ পয়সা, যেখানে ডলারের দাম প্রায় ৯৫ টাকা। রুবলে তেল কেনা হলে খরচ অনেকটাই কমে যাবে বলে মনে করছেন সংশিল্ষ্টরা। জটিলতা কাটাতে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে রাশিয়া থেকে তেল আমদানিতে যথেষ্ট পরিকল্পনা থাকা উচিৎ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। রাশিয়ার ওপরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আবার সেসব দেশে বাংলাদেশের ৩০ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রম রয়েছে। সে কার্যক্রম যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, এমনটা পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, রাশিয়া থেকে তেল আমদানি নিয়ে সরকারের কূটনৈতিক পর্যায়ে কাজ করতে হবে৷ মাথায় রাখতে হবে বাংলাদেশ অনেকভাবে পশ্চিমের ওপর নির্ভরশীল। ভারতকে ছাড় দেয়া হলেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক চাপে আছে৷ সেটা যদি বোঝানো হয় তাহলে প্রক্রিয়াটা সহজ হয়ে যাবে।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

চলমান পরিস্থিতিতে নিরসনে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে সমন্বয় করার বিষয়ে গুরত্বারোপ করছেন বিশেষজ্ঞরা। সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম শহীদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, বর্তমানে জ্বালনি তেলের দাম সমন্বয়ের মাধ্যমেই সংকট নিরসন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে শুল্ক প্রত্যাহারের মাধ্যমে দাম অনেকটাই কমিয়ে ফেলা সম্ভব।

তবে তেলে শূল্ক প্রত্যাহার করলে রাজস্বে কিছুটা ভারসাম্যহীনতা তৈরি হতে পারে জানিয়ে আবু আলম শহীদ বলেন, সেক্ষেত্রে অন্যান্য খাতে শুল্ক আদায় নিশ্চিত করা উচিত। পাশাপাশি তেল বিপণনে প্রাইভেট সেক্টরকে যুক্ত করা দরকার। কারণ বিপিসির একচেটিয়া ব্যবসার কারণে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি হচ্ছে না।

অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান ঢাকাটাইমসকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের সাথে দেশের তেলের দামের সমন্বয় করা উচিত, যেটা ভারত করছে। এছাড়া রাশিয়া স্বল্পমূল্যে তেল বিক্রির যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটাও পর্যালোচনা করা উচিত। কারণ এতে দেশের বাজারে কম দামে তেল বিপণন করতে পারবে বিপিসি। এছাড়া শুল্ক প্রত্যাহারেও দাম কমানো সম্ভব। আমার ভর্তুকির প্রয়োজন নেই। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সার্বিকভাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

ADS ADS

প্রতিছবি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Comments: