পুঁজিবাজারে মুনাফা তোলার চাপ
এক বছরের বেশি সময় ধরে ইতিবাচক ধারায় থাকা পুঁজিবাজারে কয়েক দিন দরপতনের ধারা চলছে। সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনে গতকাল সোমবার প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সব সূচক কমেছে। এই দরপতনকে ‘মূল্য সংশোধন’ হিসেবে দেখছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের চেয়ে ৮৯.১৯ পয়েন্ট কমে ৭০৯৭.২৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এটি সাড়ে তিন মাসে সর্বোচ্চ দরপতন। এর আগে সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছিল গত ২৭ জুন। এদিন ডিএসইর প্রধান সূচক ১০০ পয়েন্ট কমেছিল।
kalerkanthoডিএসইর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, টানা ছয় কার্যদিবসে শেয়ারবাজারে সূচক কমেছে ২৭০ পয়েন্ট। এর মধ্যে গত দুই দিনে কমেছে ১৪৬ পয়েন্ট। আর আগের সপ্তাহের চার দিনে কমেছিল ১২৪ পয়েন্ট। বিশ্লেষকরা বলছেন, একটানা দরবৃদ্ধির পর বিনিয়োগকারীরা মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করছেন। এর প্রভাবে সূচক ও লেনদেন কমছে। এ ছাড়া ডেজ ক্যাটাগারির শেয়ারে কারসাজির পর সেগুলোর দরপতনেও সূচক পতন ত্বরান্বিত করছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিক্রি করেছে বেশি, কিনেছে কম।
গতকালের দরপতনে বেশি অবদান রেখেছে বড় মূলধনী কম্পানির শেয়ার। এর মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কম্পানির শেয়ারদর কমায় সূচক কমেছে ১১.৭৫ পয়েন্ট। বড় মূলধনী অন্য কম্পানিগুলোর মধ্যে গ্রামীণফোন, ওয়ালটন, স্কয়ার ফার্মা, আইসিবি, বেক্সিমকো ফার্মা, ব্র্যাক ব্যাংক, পাওয়ার গ্রিড, শাহজীবাজার পাওয়ার ও তিতাস গ্যাসের কারণে সূচক কমেছে সবচেয়ে বেশি।
অন্যদিকে যে ১০টি কম্পানি সূচক বাড়িয়েছে সেগুলো হলো—ইউনাইটেড পাওয়ার, বিএসআরএম লিমিটেড, রবি, সাউথবাংলা ব্যাংক, ওরিয়ন ফার্মা, সোনালী পেপার, এনআরবিসি, হেইডেলবার্গ সিমেন্ট, ফরচুন সুজ ও ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স। তবে এসব শেয়ারের দরবৃদ্ধির হার ও শেয়ারসংখ্যা তুলনামূলক কম থাকায় এই ১০ কম্পানি সূচকে যোগ করেছে কেবল ১২.১৪ পয়েন্ট। এ ছাড়া ব্যাংক খাতের কম্পানিগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে সাতটির, দর হারিয়েছে ১৯টি কম্পানি। বীমা খাতের লেনদেনে জীবন বীমা খাতের কোনো কম্পানির শেয়ারদর বাড়েনি।
২০১০ সালে বড় ধসের পর পুঁজিবাজারে সবচেয়ে ‘খারাপ’ অবস্থা গেছে ২০১৯ সাল। বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ছিল মহামারি কমার সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাজার ভালো হবে। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নানামুখী উদ্যোগে পুঁজিবাজার ফের ইতিবাচক ধারায় ফেরে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বিএসইসির দায়িত্ব গ্রহণের পর পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া হয়। দরপতন ঠেকাতে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ, মার্জিন ঋণের সীমা বাড়ানো, ব্যাংকের বিনিয়োগসংক্রান্ত বিষয় সংশোধন, আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধি, ওটিসি মার্কেট থেকে পুরনো কম্পানি বাজারে নিয়ে আসা, ভালো আইপিওর জোগান বাড়ানো, বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সার্ভেইল্যান্স ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে রোড শো করছে বিএসইসি।
এসব উদ্যোগের মধ্যেই মন্দ হিসেবে পরিচিত ‘জেড’ ক্যাটাগরির শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর পর এখন সেগুলোর দরপতন হচ্ছে বলেও মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, মৌল ভিত্তিহীন এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে ঝুঁকিতে পড়ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারী।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানা কঠোরতার মধ্যেও কারসাজিকারী চক্রটির তৎপরতা বাড়ছে বলে জানালেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবু আহমেদ। তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জেড ক্যাটাগরির অনেক শেয়ারের দাম চার-পাঁচ গুণ হয়ে গেছে। তাদের লভ্যাংশ দেওয়ার মতো ক্ষমতাও নেই। পক্ষান্তরে ভালো কম্পানির শেয়ারের দাম তেমন বাড়েনি। তার মানে বাজারে কারসাজি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, গত তিন মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিক্রি করেছে বেশি, কিনেছে কম। বাংলাদেশ ব্যাংকও ব্যাংকগুলো যাতে সীমার অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে না পারে সে জন্য কঠোর ভূমিকা রাখছে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৯ কম্পানির অস্বাভাবিক শেয়ারদর বাড়ার কারণ খুঁজতে সম্প্রতি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএসইসি। কম্পানিগুলো হচ্ছে আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, ফু-ওয়াং সিরামিক, পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, ন্যাশনাল ফিড মিল, ঢাকা ডায়িং, জিবিবি পাওয়ার, এমারেল্ড অয়েল, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্স লিমিটেড ও বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, হঠাৎ কম্পানিগুলোর শেয়ারদর অস্বাভাবিক বৃদ্ধির বিষয়টি বিএসইসির নজরে আসে। কম্পানিগুলোর শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধিতে কারসাজি হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ও ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. সায়েদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক দরপতনকে আমরা স্বাভাবিক মূল্য সংশোধন হিসেবে ধরছি। যখন টানা সূচক ও লেনদেন বাড়ছিল, তখনো মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা ছিল। পুঁজিবাজার নিজস্ব গতি অনুসারে ওঠানামা করবে। এতে বিনিয়োগকারীরা হয়তো একটু সতর্ক অবস্থানে আছেন। বেশি সতর্ক হতে গিয়ে কিছুটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। তবে আমরা বিশ্বাস করি, খুব দ্রুতই এটা কেটে যাবে এবং বাজার আবার স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসবে।’
সায়েদুর রহমান বলেন, ব্যাংকের সুদহার কম থাকায় অনেকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। মূল্যসূচক ৪০০০ থেকে ৭০০০ পয়েন্ট ছাড়ানোর পর যদি কিছুটা সংশোধিত হয়, তাতে বিনিয়োগকারীদের ভীত হওয়ার কোনো কারণে নেই। কারণ পুঁজিবাজারের অন্যান্য অনুষঙ্গ ভালো আছে।
প্রতিছবি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
Comments: