নতুন কমিটি নিয়ে যে কৌশলে এগোচ্ছে হেফাজতের দু’পক্ষ

2 June 2021, 6:03:06

বহুল আলোচিত-সমালোচিত কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের এক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর সংগঠনটির সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে ফের আলোচনা চলছে।

ইতোমধ্যে রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ও বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে খুব শিগগিরিই ঘোষণা করা হবে নতুন কমিটি। এক্ষেত্রে হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা আহমদ শফী অনুসারীদের কয়েকজন নতুন কমিটিতে ঠাঁই হতে পারে বলে সংগঠনটির একটি সূত্র জানিয়েছেন।

আবার নতুন কমিটি এখনই না করে বর্তমান আহ্বায়ক কমিটিতে ৫ থেকে ৭ জন নেতা যুক্ত করে কমিটি ১০-১২ সদস্যের করার একটি পরিকল্পনাও রয়েছে।

গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর কেন্দ্র করে ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত সহিংসতার মামলায় সারাদেশে টানা গ্রেফতার অভিযানসহ নানামুখী চাপে পড়ে কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

গত ২৫ এপ্রিল রাতে হঠাৎ এক ভিডিও বার্তায় হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্তির কয়েক ঘন্টার মধ্যে সাবেক আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে আহ্বায়ক ও সাবেক মহাসচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদী সচিব করে রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন আরও ৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি সদস্য করা হয়।

বাবুনগরীর ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে হেফাজতের কমিটি ঘোষণা দিতে তৎপর হয়ে ওঠেন শফি অনুসারীরা।

এরপর অনুসারী আলেমরাও নড়েচড়ে বসেন। তবে পরর্বতীতে কমিটি গঠন নিয়ে শফী অনুসারীদের মাঠে-ময়দানে দেখা না গেলেও তারা প্রয়াত আল্লামা শফীর পুত্র আনাস মাদানীর নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও সরকারের পদস্থ একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

এসব সাক্ষাতে বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতের কমিটির বাইরে নতুন কমিটি করতে সরকারের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত পেয়েছেন বলে এই অংশের প্রভাবশালী ও হেফাজতের কয়েকজন উদ্যোক্তা-আলেম সূত্রে জানা গেছে।

সরকারের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে তারা ইতোমধ্যে কমিটি গঠনের কাজে জেলা সফর শুরু করেছেন।

শফী অনুসারী হেফাজতের উদ্যোক্তারা বলছেন, এসব সফরে শফীর অনুরাগী আলেমদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করবেন। এক্ষেত্রে আগামী ১৫ জুন পর্যন্ত সময় নিতে চান তারা।

এদিকে, হেফাজতের শীর্ষ পদে আসীন ছিল এক নেতা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, বিতর্কিত নেতাদের বাদ দিয়ে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরাসরি রাজনৈতিক দলের পদে আছেন এমন কাউকে খসড়া কমিটিতে রাখা হয়নি। ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছেন বর্তমান আহ্বায়ক জুনায়েদ বাবুনগরী।

ওই খসড়া কমিটিতে জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির এবং নুরুল ইসলাম জিহাদীকে মহাসচিব হিসেবে রাখা হয়। ওই কমিটির বর্তমান পরিধি ৩০-৩৮ সদস্যবিশিষ্ট হতে পারে। যেখানে প্রয়াত আমীর শাহ আহমদ শফীর বড় ছেলে মো. ইউসুফকেও রাখা হচ্ছে। অচিরেই এ নতুন কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা আসতে পারে। তবে তৈরি করা খসড়া কমিটি নিয়ে হেফাজত সংশ্লিষ্টরা প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি নন।

তিনি আরও জানিয়েছেন, নতুন কমিটিতে শফী অনুসারী বেশ কয়েকজনকে রাখা হয়েছে। কিন্তু তাদের নামে এখনও স্পষ্ট করে কেউ জানাতে পারেনি। যদিও গত বছরের ১৫ নভেম্বর জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির করে ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট হেফাজতের কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেখানে হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফীর পুত্র আনাস মাদানীসহ শফী অনুসারী কাউকে রাখা হয়নি।

অন্যদিকে, হেফাজতের বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির কোন নেতা বা সংশ্লিষ্ট কারও পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে কিনা জানতে শফির পুত্র আনাস মাদানীর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তা জানা যায়নি। তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

তবে এক শফী অনুসারী জানান, তাদের সঙ্গে আহ্বায়ক কমিটির কোন নেতা এখনও পর্যন্ত যোগাযোগ করেননি। নতুন কমিটিতে তাদের রাখা হলে তারা থাকবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসলে পরে তা আমাদের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

সূত্র জানিয়েছে, নতুন কমিটিতে নায়েবে আমির পদে মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, মাওলানা আবদুল হক মোমেনশাহী, মাওলানা সালাহ উদ্দিন নানুপুরী, অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী (দেওনার পীর), মাওলানা মুহিবুল হক (গাছবাড়ি), মাওলানা আব্দুল কুদ্দুসকে (ফরিদাবাদ মাদ্রাসা) রাখা হচ্ছে। যুগ্ম মহাসচিব পদে রাখা হয়েছে মাওলানা সাজেদুর রহমান (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), মাওলানা আবদুল আউয়াল (নারায়ণগঞ্জ), মাওলানা আরশাদ রহমানী (বসুন্ধরা), মাওলানা আবু তাহের নদভী (পটিয়া) ও মাওলানা মো. ইউসুফ (আহমদ শফীর বড় ছেলে)।

কমিটি থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছেন রাজনৈতিক পরিচয়ধারী সদ্য বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হক, নাছির উদ্দিন মুনির, খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, সহকারী মহাসচিব হাসান জামিল, প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়জী, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদকমুফতি হারুণ ইজহারসহ নানা ইস্যুতে বিতর্কে জড়িয়ে পড়া হেফাজতের নেতারা।

একইভাবে আহমদ শফীর হত্যা মামলার অভিযুক্ত নেতাদেরও বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সদ্য বিলুপ্ত কমিটিতে একক আধিপত্য বিস্তারকারী ‘রাবেতা’ ও ‘জমিয়ত’ সিন্ডিকেটও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া নতুন যুক্ত হতে যাওয়া নেতারাও হবেন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক। কমিটি নিয়ে হেফাজত নেতাদের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যোগাযোগ রাখছে। তবে কবে নাগাদ এই বর্ধিত কমিটি ঘোষণা হবে তা নিশ্চিত করে বলেনি সংশ্লিষ্ট সূত্র।

এদিকে বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘শাহ আহমদ শফী (রহ.)–এর হত্যা মামলায় অভিযুক্তদের ও উসকানিদাতাদের গ্রেফতারপূর্বক বিচারকার্য দ্রুত সম্পন্ন করার দাবিতে’ সংবাদ সম্মেলন করেছে আল্লামা শফী অনুসারীরা।

এতে জুনায়েদ বাবুনগরীর কমিটির জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মাওলানা আবদুল হামিদ (মধুপুরের পীর) অংশ নেন।

প্রসঙ্গত, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে সহিংসতার ঘটনায় অন্তত ১৭ জন মানুষের প্রাণহানি হয়। এসব সহিংসতার পেছনে জড়িত থাকার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত ১৫৪টি মামলা হয়েছে।

এসব মামলায় হেফাজতের শীর্ষস্থানীয় ৩০ নেতাসহ সারাদেশে এক হাজার ২৩০ জনেরও অধিক গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই মামলাগুলোর তদন্ত করছে পুলিশ, ডিবি, সিআইডি ও পিবিআই।

এরমধ্যে হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে রয়্যাল রিসোর্টে নারীসহ জনতার হাতে ধরা পড়েন। এতে নতুন করে বিতর্কের মুখে পড়ে হেফাজত। সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে কোণঠাসা হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতারা শুরু থেকেই সমঝোতার চেষ্টা করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তারা গোয়েন্দা সংস্থা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন।

প্রতিছবি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।