রানা প্লাজা ধসের ৮ বছর: দুই মামলায় এখনও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি

24 April 2021, 12:03:24

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকার রানা প্লাজার আট তলা ভবন ধসে পড়ে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয় ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক। আহত হন আরও কয়েক হাজার শ্রমজীবী মানুষ। এ ঘটনায় চারটি মামলা করা হয়। চার মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে কেবল একটির। ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে দায়ের করা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬। বাকি তিন মামলার বিচারকাজ সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে ঝুলে আছে।

এর মধ্যে হত্যা মামলাটি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। ইমরাত নির্মাণ আইনে দায়ের করা দুই মামলার মধ্যে রাজউকের মামলাটি ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং ইমারত নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা মামলাটি ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন।

দীর্ঘ আট বছরে চারটি মামলার মধ্যে শুধু সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে রানা ও তার মায়ের বিরুদ্ধে দুদকের একটি মামলার নিষ্পত্তি হলেও বাকি তিনটি নিষ্পত্তির মুখ দেখছে না। হত্যা ও ইমারত আইনের রাজউকের মামলাটির এখনও সাক্ষ্যগ্রহণই শুরু হয়নি।

রানা প্লাজা হত্যা মামলা

রানা প্লাজা ধসের ঘটনার পরদিন ভবন নির্মাণে অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যার অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় অভিযোগ পত্রে ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করা হয়। আসামি ৪১ জনের মধ্যে তিন আসামি মারা যান। এখন আসামির সংখ্যা ৩৮ জন।

২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করলেও এখন পর্যন্ত একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়নি।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মিজানুর রহমান বলেন, ‘মামলাটির অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন ছয় আসামি। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ছয়জনের জন্য স্থগিতাদেশ প্রদান করেন উচ্চ আদালত। পরে চারজনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়। তিনি জানান, দুই আসামি সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাত উল্লাহ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজি মোহাম্মদ আলীর পক্ষে এখনও স্থগিতাদেশ থাকায় বিচারকাজ বা সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে আমরা অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছ চারবার লিখিত আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু কোনও উত্তর পাইনি।’

তিনি আরও বলেন, মামলাটিতে ৫৯৪ জন সাক্ষী রয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য খোঁজ খবর নেন। কিন্তু আমরা তাদের বলছি, আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে আপনাদের জানাবো। মূলত ওই দু’জনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলেই বিচারিক কার্যক্রম শুরু করতে পারবো বলে আশা করছি।

ইমারত আইনে রাজউকের মামলা: আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ইমারত নির্মাণ আইনে সাভার থানায় আরেকটি মামলা করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ১৩০ জনকে মামলার সাক্ষী করা হয়।

২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। তবে এ মামলায়ও এখন পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনোয়ারুল কবির বাবুল বলেন, ‘আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে গিয়ে অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিভিশন মামলা করে। এরপর উচ্চ আদালত কার্যক্রম স্থগিত করেন। একই কারণে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে ঝুলে আছে।’

ইমারত আইনে দুর্নীতি মামলা: রানা প্লাজা ট্রাজেডির পরপরই ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ছয়তলার অনুমোদন নিয়ে ৮ তলা নির্মাণ করা হয়েছিল রানা প্লাজা। এই দুর্নীতির কারণে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা ও দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় সাভার থানায় ২০১৩ সালের ১৫ জুন একটি মামলা দায়ের করে দুদক। ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক মফিদুল ইসলাম। বর্তমানে মামলাটি ঢাকা বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, ‘মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে আদালত বন্ধ থাকায় কার্যক্রম চলছে না। পরিস্থিতি কেটে গেলে মামলাটির বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারবো বলে আশা করছি।’

জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগে দুদকের মামলা: ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল দুদকের সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলম বাদি হয়ে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ও তার মা মর্জিনা বেগমের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলাটি দায়ের করেন। রানা প্লাজার নির্মাণের তথ্য গোপন করে দুদককে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে ছয় কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯০০ টাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করার অভিযোগ করা হয়।

২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট এ মামলার রায় দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬-এর বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস। এই মামলার রায়ে সোহেল রানাকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ের আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

একই মামলায় তার মা মর্জিনা বেগমকেও তিন বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একইসঙ্গে অবৈধভাবে অর্জিত সাভার বাজার রোডের ৬৯/১ বাড়িটির এক-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়।

রানার আইনজীবী ফারুক আহাম্মেদ যা বললেন: রানা প্লাজা হত্যা ও ইমারত আইনে দুটি মামলায় দীর্ঘ আট বছরেও বিচার শুরু করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। এ মামলায় কারাগারে থাকে একমাত্র আসামি রানা ছাড়া সকলে জামিন আছেন। এ প্রসঙ্গে ফারুক আহম্মেদ বললেন, ‘বিনাবিচারে তো একজন আসামিকে এভাবে আটক রাখা যায় না।’

প্রতিছবি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।