সক্ষমতা বাড়ছে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে

21 March 2021, 10:42:52

দেশের উদীয়মান সম্ভাবনাময় খাত জাহাজ নির্মাণ শিল্প। এই খাতে দেড় লক্ষাধিক দক্ষ ও অর্ধদক্ষ শ্রমিক বর্তমানে কাজ করছেন। প্রায় ২০ লাখ মানুষ নানাভাবে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। অতীতে অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী জাহাজগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও কয়েক বছর ধরে দেশেই তৈরি হচ্ছে সব অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় জাহাজ।

২০০৮ সালে প্রথম বাংলাদেশ সাফল্যের সঙ্গে সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি করেছে। এ জন্য ভারত, চীন এবং ভিয়েতনামের মতো বৃহৎ জাহাজ নির্মাণকারী দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে সাফল্য দেখিয়েছে। বাংলাদেশের অনেক জাহাজ নির্মাণ কারখানা এখন ১০ হাজার টন ধারণক্ষমতার জাহাজ নির্মাণে সক্ষম। বর্তমানে আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেড এবং ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেডের মতো জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান আধুনিক জাহাজ নির্মাণে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা অর্জন করেছে।

২০০৮ সালে ডেনমার্কে অত্যাধুনিক কনটেইনার জাহাজ ‘স্টেলা মারিস’ রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য জাহাজ রপ্তানির স্বর্ণদ্বার উন্মোচন করে আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেড। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ জাহাজ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। বেসরকারি খাতে এটিই বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে তৈরি সর্ববৃহৎ জাহাজের রেকর্ডও রয়েছে আনন্দ শিপইয়ার্ডের। প্রতিষ্ঠানটি ইউরোপীয় ও আফ্রিকান বিভিন্ন দেশে ৩৪টি জাহাজ রপ্তানি করেছে। আনন্দ শিপইয়ার্ডের তৈরি জাহাজ ডেনমার্ক, জার্মানি, নরওয়ে, মোজাম্বিকসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের জন্য ৩৬৫টি জলযান নির্মাণ করেছে।

আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ড. আব্দুল্লাহ হেল বারী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাহাজ নির্মাণ শিল্প দীর্ঘদিন কঠিন সময় পার করলেও এখন আবারও সুদিন ফিরে আসতে শুরু করেছে। বিদেশে ক্রেতারা আবারও বাংলাদেশের তৈরি জাহাজ কেনার আগ্রহ দেখাচ্ছে। জাহাজ রপ্তানির পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। আশা করি জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সোনালি দিন আবারও ফিরে আসবে।’

গুণগত মানের দিকে বেশি নজর দেওয়া হয় উল্লেখ করে ড. আব্দুল্লাহ হেল বারী আরো বলেন, ‘দেশে অনেক জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে আনন্দ শিপইয়ার্ড কখনো কোয়ালিটি প্রডাক্ট তৈরিতে কম্প্রোমাইজ করে না। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বড় জাহাজ রপ্তানির রেকর্ড রয়েছে আনন্দ শিপইয়ার্ডের। আমরা এ পর্যন্ত ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের অর্থ আয় করেছি জাহাজ রপ্তানি করে। এখন অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য জাহাজ তৈরি করছি।’

দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে যারা বিশ্ববাজারে পরিচিত করেছে তাদের অন্যতম চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আয় করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্যাপ্টেন সোহেল হাসান বলেন, ‘গত ২১ বছরে দেশি-বিদেশি বাজারের জন্য আনুমানিক ১৫০টিরও বেশি জাহাজ নির্মাণ করেছি আমরা। গড়ে প্রতিবছর সাতটির বেশি জাহাজ নির্মাণ হয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডে। যে সব দেশে রপ্তানি হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে—জার্মানি, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ইকুয়েডর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তানজানিয়া, উগান্ডা, গাম্বিয়া, কেনিয়া, ভারত এবং পাকিস্তান। বর্তমানে নরওয়ে, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ভারতে রপ্তানির জন্য ছয়টি জাহাজ নির্মাণ চলছে।’ এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর, পায়রা বন্দর, বিআইডাব্লিউটিসি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আরো বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি খাতের জন্য মোট ২৭টি জাহাজ নির্মিতব্য রয়েছে।

ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের এমডি আরো বলেন, ‘নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম বন্দর, মংলা বন্দর, বিআইডাব্লিউটিসি, খুলনা শিপইয়ার্ড, চট্টগ্রাম ড্রাইডকের জন্য এ পর্যন্ত মোট ১৫টি জাহাজ তৈরি করেছি। দেশীয় বাজারে জাহাজ সরবরাহ করে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড জাহাজ আমদানির বিকল্প ধারা হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে এক বিশাল ভূমিকা রাখছে।’

নিজেদের সক্ষমতার বর্ণনা দিতে গিয়ে ক্যাপ্টেন সোহেল হাসান বলেন, দেশে তৈরি সর্বপ্রথম এবং বৃহৎ রো রো ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডে নির্মিত, যা ২০১২ সালে বিআইডাব্লিউটিসিকে হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালে গোলাম মওলা নামের আরো একটি রো রো ফেরি বিআইডাব্লিউটিসিকে সরবরাহ করি আমরা। এর আগে ২০১০ সালে কনকচাঁপা এবং দোলনচাঁপা নামের দুটি ইউটিলিটি ফেরি তাদের কাছে হস্তান্তর করে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। আরো রয়েছে বিআইডাব্লিউটিসি পরিচালিত যাত্রীবাহী জাহাজ ‘বাঙালি’ ও ‘মধুমতি’ এ দেশে তৈরি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী জাহাজ যা ওয়েস্টার্ন মেরিনের তৈরি।

সার্বিক বিবেচনায় এই সেক্টর বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্পের চেয়েও অধিক সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময়। এ কারণে বাংলাদেশ সরকার এই সেক্টরকে বিশ্বময় পরিচিত করতে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘সার্ট থেকে শিপ’ শিরোনামে একটি স্লোগান বাস্তবায়ন করেছে বলে জানান ক্যাপ্টেন সোহেল হাসান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের মেগা প্রজেক্টে অবদানের মাধ্যমে এটি অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখতে পারে। যার মধ্যে সেতু নির্মাণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উন্নয়ন, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উন্নয়ন, গভীর সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন, জ্বালানি ও গ্যাস স্টোরেজ টার্মিনাল উন্নয়ন ইত্যাদিতে মূল্য সংযোজন করতে পারে। ভবিষ্যতে জাতীয় চাহিদা মেটাতে এই শিল্পকে উন্নত করতে সরকার জাহাজ নির্মাণকে একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত হিসেবে ঘোষণা করেছে।’

দেশে প্রায় অর্ধশতাধিক শিপইয়ার্ড এবং শতাধিক মেরিন ওয়ার্কশপ সক্রিয় রয়েছে। শিপইয়ার্ডগুলোর ৭০ শতাংশ ঢাকা এবং এর আশপাশে অবস্থিত, ২০ শতাংশ চট্টগ্রামে এবং ১০ শতাংশ খুলনা ও বরিশালে অবস্থিত। দেশের চাহিদা পূরণ করে এসব শিপইয়ার্ড এখন বিদেশেও জাহাজ রপ্তানি করছে। দেশে আনুমানিক ১০ হাজার মেট্রিক টন ক্ষমতার আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জাহাজ তৈরির ক্ষমতাসম্পন্ন প্রায় ১১টি শিপইয়ার্ড রয়েছে। এগুলো হলো আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, খুলনা শিপইয়ার্ড, কর্ণফুলী স্লিপওয়ে, হাইস্কিড শিপবিল্ডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, ঢাকা ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, চিটাগাং ড্রাইডক, নারায়ণগঞ্জ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড শিপবিল্ডিং, চিটাগাং শিপইয়ার্ড এবং বসুন্ধরা স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং।

প্রতিছবি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।