ইন্টারনেট
হোম / অর্থনীতি / বিস্তারিত
ADS

পুঁজিবাজারে ভয়াবহ পতন

14 November 2025, 5:39:10

সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) দেশের শেয়ারবাজারে বিরাট দরপতন হয়েছে। এক দিনেই প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ১২২ পয়েন্ট কমে গেছে। আর বাজার মূলধন কমেছে ৭ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকার বেশি।

২০২৪ সালের আগস্টে খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার সময় ডিএসই সূচক ছিল ৫৭৭৮.৬৩ পয়েন্ট। আজ (১৩ নভেম্বর) তা নেমে এসেছে প্রায় ৪৭০২ পয়েন্টে। এই সময়ে বাজার মূলধন যেমন কমেছে, তেমনি লেনদেনের পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে।

দেশ সামগ্রিক অর্থনীতির দিক থেকে অনেক এগিয়েছে, রপ্তানি আয় বেড়েছে, প্রবাসী আয় স্থিতিশীল, মুদ্রাস্ফীতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আসছে, কিন্তু পুঁজিবাজার যেন সেই পুরোনো সংকটেই আটকে আছে।

দীর্ঘ সময় ধরেই বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করে আসছেন যে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হঠকারী সিদ্ধান্তই বর্তমান পুঁজিবাজারের বেহাল অবস্থার মূল কারণ। সাম্প্রতিক সময়ের দরপতন, লেনদেনের খরা, বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা—সব মিলিয়ে এক গভীর অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে এই বাজারে।

সম্প্রতি মার্জিন ঋণ নীতিমালা সংশোধন ও পাঁচ ব্যাংকসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারে তীব্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে বাজারে হঠাৎ করে তারল্য সংকট দেখা দেয়, বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। প্রতিদিনের লেনদেন ক্রমেই কমতে থাকে, বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারদর নিম্নমুখী। এক বছরের ব্যবধানে সূচক নেমে আসে সর্বনিম্ন অবস্থানে।

টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীরা পড়েছেন ফোর্স সেলে। সূচকের পতন এখন প্রতিদিনের নিয়মে পরিণত হয়েছে—যে বাজার একসময় দেশের উন্নয়ন সম্ভাবনার প্রতীক ছিল, সেটি এখন বিনিয়োগকারীদের জন্য উদ্বেগের আরেক নাম। বাজারের এই অবস্থার পরও সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে পুঁজিবাজার নিয়ে বিশেষ আগ্রহ বা নীতিগত হস্তক্ষেপের অভাব বিনিয়োগকারীদের হতাশ করছে। অনেকেই মনে করেন, সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবই বাজারকে এই দুরবস্থায় ফেলেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও ১৪ মাস পার হয়ে গেছে, কিন্তু পুঁজিবাজারে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই। বরং এই সময়ের মধ্যে ডিএসই সূচক কমেছে ১০৭৫ পয়েন্ট। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন—অর্থনীতির অন্যান্য খাত সংস্কার ও পুনরুদ্ধারে সফল হলেও পুঁজিবাজার কেন পিছিয়ে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় পেশাদারিত্বের অভাব এবং বিনিয়োগবান্ধব নীতি না থাকা বাজারকে ক্রমেই দুর্বল করছে। বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ বা পরামর্শ ছাড়াই নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো বাজারে আস্থার সংকট তৈরি করেছে। ২০২৪ সালের আগস্টে খন্দকার রাশেদ মাকসুদ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার সময় ডিএসই সূচক ছিল ৫৭৭৮.৬৩ পয়েন্ট। বর্তমানে তা নেমে এসেছে প্রায় ৪৭০২ পয়েন্টে। এই সময়ে বাজার মূলধন যেমন কমেছে, তেমনি লেনদেনের পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে।

বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে, নতুন কমিশন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বাজারে বড় কোনো বিনিয়োগকারী বা প্রতিষ্ঠান কিছু পরিমাণ বেশি শেয়ার কিনলেই বিএসইসি থেকে ফোন দিয়ে কারণ জানতে চাওয়া হয়। এতে বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, কর্তৃপক্ষের নজরদারি পেশাদারিত্বের জায়গায় নয়, বরং আতঙ্ক সৃষ্টির পর্যায়ে চলে গেছে। এর ফলে নতুন বিনিয়োগকারী যুক্ত হওয়ার আগ্রহও কমে যাচ্ছে।

দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বিদেশি ফান্ড ম্যানেজাররা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনিশ্চিত নীতি, অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত এবং বাজারে স্বচ্ছতার অভাব তাদের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। একসময় বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় ছিল তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী। কিন্তু বর্তমানে নতুন কোনো কোম্পানির তালিকাভুক্তি নেই, বিদ্যমান কোম্পানিগুলোর আয় ও মুনাফাও কমছে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিকল্প বাজারের দিকে ঝুঁকছেন।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষণ
পুঁজিবাজারে টানা দরপতন শুধু বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বাজার মূলধন হ্রাস মানে রাজস্ব কমে যাওয়া, কোম্পানিগুলোর নতুন বিনিয়োগে অনীহা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়া। বিনিয়োগকারীরা এখন সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। অনেকেই আশা করছেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস নিজে সরাসরি এই খাতে নজর দেবেন, যাতে বাজারে নীতিগত স্থিতিশীলতা ও আস্থা ফিরে আসে।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বারবার সংকটে পড়েছে, কিন্তু প্রতিবারই দেখা গেছে—সংকটের মূলে রয়েছে আস্থার অভাব, হঠকারী সিদ্ধান্ত ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। আজও সেই একই চিত্র। বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত, বাজারে লেনদেন কমছে, নতুন কোম্পানির প্রবেশ নেই—সব মিলিয়ে স্থবির একটি পরিবেশ। এই অবস্থায় প্রয়োজন একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা, বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ এবং বাজারে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনা—এসব ছাড়া বর্তমান সংকট কাটানো সম্ভব নয়।

অর্থনীতির গতি ফিরছে, মুদ্রাস্ফীতি কমছে, বৈদেশিক রিজার্ভ কিছুটা স্থিতিশীল হচ্ছে—তবুও পুঁজিবাজার যদি ঘুরে না দাঁড়ায়, তবে তা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার জন্য এক বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সময় এসেছে, নীতিনির্ধারকদের আন্তরিক ও বিচক্ষণ পদক্ষেপ নেওয়ার, যাতে পুঁজিবাজার আবারও দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে।

ADS ADS

প্রতিছবি ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Comments: